Thursday, July 15, 2010

পুরনো গাড়ি নিষিদ্ধ করার সরকারী ব্যবসা বন্ধ হোক

বাংলাদেশে যারা সরকারী ক্ষমতায় যায় বা যারা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে কর্মরত আমলা তারা জনগণের সেবায় খুব কমই মনোনিবেশ করেন। ক্ষমতাধরদের নিজেদের ব্যবসায়িক উন্নতিসাধনের পথে যদি জনগণের কোন উপকার সয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায় তাহলে তো খুবই ভাল কথা। এ ধরনের কাজে উভয়দিক থেকে ক্ষমতাধরদেরই লাভ। একদিকে জনগণ তাদের সেবা করা হয়েছে ভেবে সন্তুষ্ট থাকল। আবার ব্যবসা করে তাদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ ও হল।

প্রায় এক যুগ আগে দূষণের কথা বলে দুই স্ট্রোকের ইঞ্জিনবিশিষ্ট আমাদের অতি পরিচিত বেবি ট্যাক্সিগুলোকে যখন ঢাকা থেকে বিতাড়িত করা হল তখন আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি যে কিছু গাড়ি ব্যবসায়ীর রাতারাতি বিলিয়নপতি হয়ে যাওয়ার পথ খোলার জন্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব গাড়ি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তা যদি নাই হবে তাহলে ভারতীয় রুপি পঞ্চাশ হাজার দিয়ে যে সিএনজি বেবি ট্যাক্সি ভারতে বেচাকেনা হয়, তা বাঙলাদেশে পাঁচ থেকে সাত লক্ষ টাকা দাম হয় কীভাবে?

আমি যখন কথাটা জানলাম- একটা পুরনো সিএনজি বেবি ট্যাক্সি কিনতে এখন খরচ হয় পাঁচ লক্ষ টাকা আমি বিস্মিত হলাম। কারণ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি এত বেশি দাম হতে পারে এত হাল্কা এবং সস্তা ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটা গাড়ির। ফলত কী দাঁড়াল? ঢাকা শহরের প্রায় তিনকোটি সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এর মাশুল গুণছেন। তিরিশ টাকা ভাড়ার পথ এখন একশ' টাকা দিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে।

একথা পরিষ্কার যে, বাঙলাদেশে যখনই কোন নতুন আইন বা নিয়ম চালু হয় তা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিছু লোককে সুবিধা দিতে; পাশাপাশি আপামর জনগণকে অসুবিধায় ফেলতে। আমি ছ'মাস আগে ঢাকায় যখন একটা সিএনজিতে উঠি তখন দেখলাম এর দু'দিকে লোহার গ্রিল দিয়ে দরজা বানিয়ে প্যাসেঞ্জারকে খাঁচার জন্তুর মত পরিবহন করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বেবি ট্যাক্সি অপারেটর আমাকে জানালেন এটা যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে বেবি ট্যাক্সিযোগে যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তা ঠেকানোর জন্য। কিন্তু মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে ঠিক কীভাবে ছিনতাইয়ের মত ঘটনার হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে এ নিয়ম করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য হয়নি। কারণ ড্রাইভার যদি দরজা তালা বন্ধ করে দেয় তাহলে যাত্রী ওখান থেকে বের হবার কোন উপায় নেই।

অতপর, ড্রাইভার সাহেব আমাকে জানালেন পুলিশ যদি রাস্তায় জিজ্ঞেস করে আমি মিটারের হিসেবে ভাড়া দেব নাকি ফিক্সড রেটে যাচ্ছি, তাহলে আমি যেন বলি মিটারে যাচ্ছি। যেহেতু সায়েদাবাদ থেকে একশ' আশি টাকার কমে আমি কাউকে শঙ্কর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে রাজি করাতে পারি নি। উপরন্তু আমার যাওয়া প্রয়োজন বাসট্যান্ড থেকে থেকে একটু ভিতরে জাফরাবাদ কিন্তু কেউ ভিতরে যেতেও রাজি হল না।

যাহোক আমার মূল কথা হল সরকার নিয়ম করেছিল মিটার ছাড়া ভাড়া আদায় করা যাবে না। কিন্তু রাস্তায় যখন একজন যাত্রী হাতে চার-পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে শিশু এবং মহিলাসহ যাতায়াত করেন তখন বেবি ট্যাক্সি বা ক্যাব অপারেটরদের কথা একপর্যায়ে মানতে তারা বাধ্য হন।

কিন্তু তার দু'সপ্তাহ পড়ে আমি যখন আবার সিএনজি বেবি ট্যাক্সিতে উঠলাম তখন আর ড্রাইভার আমাকে তেমন কোন অনুরোধ করলেন না। আমি জানতে চাইলে তিনি বললেন সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কারণ এখন বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে তারা পুলিশকে প্রতিদিনের মাশুল দিয়ে সে নিয়ম মানার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এখন কোন যাত্রী পুলিশকে যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও অভিযোগ করেন তাহলেও কোন কাজ হবে না।

নিয়ম কানুন, আইন-আদালত বাঙলাদেশে মানুষের উপকারের জন্যই আছে! তবে তাতে কোন ক্ষমতাবানের বিচার হয় না। সাধারণ জনগণ এই আইন-আদালত থেকে কোন উপকার পায় না। পাবে না। কথাটা প্রমাণিত হয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের একটি অংশকে বর্তমান সরকারের বাছবিচারহীনভাবে বিনাশর্তে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে।

প্রাচীন রোম ও গ্রিসে যে নগররাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল সেখানেই নাকি গণতন্ত্রের উৎপত্তি তা অনেকে জানেন। পাঠক এও জানেন তখনকার সচেতন নাগরিকদেরকে গণতান্ত্রিক উপায়েই দেশের বিচারকগণ মৃত্যুদণ্ডও দিতেন। এ ভাবেই মহামতি সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঙলাদেশেও প্রাচীন গ্রীসের সে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার আদলেই গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে।
শুরুতে যে কথা বলছিলাম ইতালিয়ান এঞ্জিন বিশিষ্ট প্রাচীন বেবি ট্যাক্সির বদলে সিএনজি বেবি ট্যাক্সির প্রচলন করে দেশের কিছু লোকের হাতে গরীর খেটে খাওয়া সিএনজি অপারেটরদের কষ্টার্জিত অর্থ তুলে দেওয়ার সিস্টেম চালু করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। যেখানে একজন ড্রাইভার হতে পারতেন সিএনজির মালিক সেখানে এখন ড্রাইভার পাঁচ-দশ বছর সিএনজি চালিয়েও মালিক হতে পারছেন না। কারণ তার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে সিএনজি বেবি ট্যাক্সির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফরিয়াদের পকেটে চলে যাচ্ছে শ্রমিক জনতার তথা মেহনতী মানুষের অর্থ।

ঘুষখোর প্রশাসন আর তাদের ক্লায়েন্টদের পকেটে চলে গেল সকল অর্থ। সাধারণ জনগণ হয়ে রইল খাঁচায় বদ্ধ চিড়িয়া।
এখন সরকারের কোন মন্ত্রীমিনিস্টার বা প্রশাসনের কোন ভারি মাথার লুলুপ দৃষ্টি পড়েছে একই রকম ব্যবসায়। আবার তারা বলছেন ঢাকায় বিশ বছরের পুরনো বাস, মিনিবাস চলতে দেয়া হবে না। এটা একটা চরম অন্যায্য যুক্তি। কারণ পৃথিবীর সকল দেশেই, সকল শহরেই পুরনো গাড়ি চলতে কোন বাধা নেই। যতক্ষণ এগুলো রাস্তায় চলার জন্য ফিট থাকবে ততক্ষণ এগুলো শহরের রাস্তায় চলতে পারে।

ঢাকার রাস্তাতো কোন এক্সপ্রেস হাইওয়ে না। যে এখানে দ্রুতগতির গাড়ি চালাতে হবে। ঢাকার রাস্তায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর কোন সুযোগ কোন অবস্থাতেই নেই। তারপরও এখানে নতুন নতুন যেসব গাড়ি নামানো হয়েছে সেগুলোর ইফিশিয়েন্সি অনেক কম। টাটা গাড়ি বা যত ভারতীয় গাড়ি আমি দেখেছি নতুন নতুন নামে নতুন সাজে তা শুধুমাত্র কিছু লোকের গাড়ির ব্যবসা বাড়ানোর জন্যই অতীতের সরকারগুলো এসব সুযোগ দিয়েছে। এসব গাড়ি গত ৮ থেকে ১০ বছর চলেই ইতিমধ্যে বেশ লক্করঝক্কর হয়ে গেছে।

অনুরূপ বর্তমান সরকার আসার পর এখন তাদের চেলা-চাটুকাররাও হয়তো বলছেন তাদের কিছু আয় রোজগার বাড়ানোর পথ বের করতে। তাই এখন আবার বর্তমান সরকার পুরনো অথচ ভালভাবে সচল বাস-মিনিবাসগুলোকে বের করে দিয়ে আগের মতই কিছু লোকের গাড়ি আমদানির ব্যবসা বাড়ানো এবং কিছু লোকের ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন উদ্ভট পরিবহন নাম দিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনিক গাড়িভাড়ার খরচ বাড়ানোর একটা ঘৃণিত পরিকল্পনা করেছে সরকারের উপদেষ্টা!রা।

বিদেশ থেকে আমরা যতই গাড়ি আমদানি করি এসবই আমাদের পরিবেশকে দূষণ করছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে নিঃশেষ করছে। আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়ার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। সরকার কেন এসব পরিকল্পনা করবে। একটা গণতান্ত্রিক সরকারের সকল এমপিরা বিত্তবাণ ক্ষমতাধর। তারা সাধারণ জনগণের সেবা কীভাবে করবেন!
তারা জানেন কীভাবে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া যায়। যারা রাজনৈতিক আন্দোলনে মারা পড়েন তারা বলতে পারবে না দেশের জন্য মরেছেন। বরং রাজনীতি ব্যবসায়ের উন্নতির জন্যই জীবন দেন তারা। প্রকৃত রাজনীতিক একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যারা প্রকৃতপক্ষেই জনগণের উপকারে কিছু করতে চান।

নষ্ট হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ গাড়িঘোড়া মেটালের জঞ্জাল বাড়াবে, পরিবেশ দূষণ করবে। পরিবেশবাদীরা রি-ইউজ এবং রি-সাইকেল করার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের যে বিদ্যমান গাড়িঘোড়া আছে সেগুলোকেই আমাদের রি-ইউজ করা অতি জরুরী। মেটালের স্তুপ না বাড়িয়ে আমাদের উচিত কীভাবে দেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করা যায় সে চেষ্টা করা। আমাদের দেশে যত গাড়ি আছে সেগুলোকে রি-ইউজ করা দরকার। গাড়ি ব্যবসায়ীদের কিছুটা দমতে হবে এখন। বাড়তি গাড়ির জন্য ঢাকার রোড স্পেস বা রাস্তার ধারণক্ষমতা এবং পার্কিং এর জায়গা মোটেও নেই। আমরা যত বেশি গাড়ি দেশে আমদানি করব ততবেশি আমাদের যানজট, পরিবেশ দূষণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যতবেশি আমরা রি-ইউজ করতে থাকব ততবেশি আমরা দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনগণকে রক্ষা করতে পারব।

দেশের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর এ কথা বোধগম্য হওয়া দরকার।

No comments:

Post a Comment