Sunday, June 13, 2010

ন্যুইয়র্কের বাঙালি অভিবাসী সাংবাদিকতা

ন্যুইয়র্ক এসেছি চারমাস হল। দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর। এখানে বসে থাকার কোন ব্যবস্থা নাই। এসেই কী করব ভেবে পাইনা। এদিকে সপ্তাহ শেষে ঘরভাড়া দিতে হবে। মাসের শেষে টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল দিতে হবে। বিদ্যুত বিল, প্রতিদিন কম্যুটিং এর জন্য মেট্রো রেলে বা বাসে ভাড়ার পয়সা গুণতে হচ্ছে। কাজ খুঁজতে যাওয়া আসারও খরচও নেহাত কম না। তারপর দুপুরবেলা খিদে পেলে জাইরো, স্যান্ডউইচ, সিঙ্গারার খরচ আছে। দুই থেকে ছয় ডলার খরচ হয় লাঞ্চ করতে।

এখানে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে বলেছি কাজের সন্ধান দিতে। কাজ জুটেছে কনভেনিয়েন্ট স্টোরে। দোকানদারি। ভাল কাজ। কিন্তু বেতন কম। ঘণ্টা হিসেবে পয়সা দেয় সবাই। কাজের মনিব যদি মনে করে কামাই কম হচ্ছে তখন নিজের রোজগারে যাতে প্রভাব না পড়ে সে জন্য অগ্রিম সতর্কতা হিসেবে আওয়ার কমিয়ে দেয় কর্মচারীর। স্বল্পপুঁজির দোকানপাটের কথা বাদ দিলেও মাঝারি, বড় এমনকি কর্পোরেশনগুলোতেও ২০০৭ সালের আমেরিকার অর্থনৈতিক ধ্বসের ফলস্বরূপ গত তিনবছর এখানে লক্ষ লক্ষ লোকের চাকুরিচ্যুতি থেকে শুরু করে নানা ধরনের দুঃসংবাদ লেগেই আছে। কয়েকদিন আগেও আমার বন্ধু দ্বিতীয় যে কাজটি করত রেস্তোরাঁয় সে কাজ চলে গেল। তারা আর পার্ট টাইমার রাখবে না। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের খরচ বাঁচানো দরকার।

৭০ হাজার কোটি ডলারের উদ্ধার প্রস্তাব পাশ করেও আমেরিকার সরকার সাধারণ নাগরিকদের কোন স্বস্তি দিতে পারেনি এখনও।
মানুষ চাকুরি হারানো থেকে শুরু করে আয়রোজগারে অধগতি উপরন্তু দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, যাতায়াত ভাড়া, ঘরভাড়া ইত্যাদি বৃদ্ধিসহ চারদিকের চাপে মানুষ ন্যুব্জ। ফলে রেস্টুরেন্ট, গ্যাস স্টেশন, গ্রসারি, কনভেনিয়েন্ট স্টোরের ব্যবসাগুলোতে খরিদ্দারদের ভীড় আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। সকলের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে যা তামাম যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

এমন এক সময়ে আমি এসেছি ন্যুইয়র্ক শহরে। ভেবেছিলাম বড় শহরের অনেক সুযোগের ভিড়ে আমি নিজের জায়গা করে নিতে পারব। কিন্তু তার কোন আলামত পেলাম না প্রথম একমাস।

একমাস পরে শুরু করলাম টিউশানি। ন্যুইয়র্ক শহরে ঢাকা শহরের মতই মসজিদ, ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসা তথা ইসলামিক স্কুল আর কোচিং সেন্টারে ভর্তি। মন্দির, গির্জা, পেগোডারও অভাব নেই এখানে। অমুক ক্যাথলিক চার্চ, অমুক ব্যাপ্টিস্ট চার্চ গলিতে গলিতে; কেউ শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত তো কেউ রামের, কোন কিছুরই অভাব নেই। পাশাপাশি ডেভিল আর সেইন্টের দেখা মিলবে এই ন্যুইয়র্ক শহরেই। মসজিদের ধারেকাছেই হয়ত মিলবে নগ্ন নৃত্যের ক্লাব। মোটকথা সবধরনের সুযোগই আছে এখানে। তাই এখানে আসল সাধু আর আসল চোরের দেখা মেলে। কারো সুযোগের অভাবে সাধু সাজার দরকার পড়ে না এখানে। তাই মানুষের আসল চেহার বেরিয়ে পড়ে এই ন্যুইয়র্ক শহরে।

যে কথা বলছিলাম, টিউশানি করে এখানে লক্ষ লক্ষ ডলারের কোচিং সেন্টারের মালিক হয়েছেন কেউ কেউ। আমি নতুন এসে কি জায়গা পাই এখানে? তবুও একটা সেভেনের বাচ্চাকে অঙ্ক করানোর কাজ পেলাম; তবে রোজগার তেমন কিছু না। নতুন মাস্টারকে চলতি রেট দিবে কেন? আমার নামডাক হলে আমাকে প্রয়োজনে দিগুণ দিতেও গায়ে লাগবে না।

একসময় ভাবলাম আচ্ছা এবার দেখি নিজের পেশা সাংবাদিকতায় কী করতে পারি। ন্যুইয়র্কে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় পনের ষোলটা সাপ্তাহিক বাঙলা পত্রিকা বেরয়। তারা শুধু বিজ্ঞাপনের পয়সা রোজগারের জন্যই পত্রিকা ছাপায় এমন না, কেউ কেউ সমাজে অর্থের পাশাপাশি নামডাকের জন্যও পত্রিকা প্রকাশ করেন। টিপিক্যাল। পেশাদারিত্ব নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কতটুকু সে প্রশ্নে আসছি পরে।

বেশিরভাগ পত্রিকা মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গেলে বা চাল-ডাল কিনতে গেলে বিনামূল্যে মেলে। তারই একটা নিয়ে আমার ন্যুইয়র্কের সাংবাদিকতার সূচনা করব বলে ফোন তুললাম। নিজের কথা বললাম। অপর প্রান্ত থেকে জানাল আমাদের বসকে ফোন দিন তিনি বলতে পারবেন কাজ আছে কি না। দিলাম বসকে ফোন। বলালাম সাংবাদিকতায় পড়াশুনার পাশাপাশি পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বললেন অমুকদিন আসুন। রেজুমে নিয়ে গেলাম তার কাছে। তিনি পেশায় ডাক্তার।

জানালেন তার পত্রিকার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার কথা। পত্রিকার পেজমেকাপ হয় বাংলাদেশে। অর্থাৎ পেজমেকাপ রিমোটলি কন্ট্রোলড্। তিনি আমার ডিগ্রি বা পেশাদারিত্বের দিকে কর্ণপাতও করলেন না। বরং তার নিজস্ব সিস্টেমে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানালেন। তার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিদের অসততার কথা বললেন। আমি নিজের ব্যাপারে কিছু বলে নিজের যোগ্যতা যতবারই জাহির করতে গেলাম ততবারই তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকা প্রকাশ করছেন অতএব তিনি ন্যুইয়র্কে পত্রিকা পরিচালনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বোঝেন। যাই হোক আমাকে কাজ দেবার কোন পরিস্কার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে একসপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে বললেন।

আমি যতবারই তার সাথে কথা বললাম ততবারই বোঝাতে চেয়েছি সাংবাদিকতার ধরন পরিবর্তনের কথা কিন্তু তিনি এসব নিয়ে নতুন করে কোন এক্সপেরিমেন্ট করতে নারাজ।

ন্যুইয়র্কের বাংলাদেশি কম্যুনিটির দিকে তাকালে বোঝা যায় আসলে সাংবাদিকতার মৌলিক চর্চা ঠিক রাখতে গেলেও যে ধরনের enterprise দরকার তা এখানে অনুপস্থিত। যদি সে ধরনের কোন informed উদ্যোক্তা থাকেন তাহলে এখানে বাঙলা সাংবাদিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে হয়েছে আমার। যাই হোক উল্লেখিত ডাক্তার সাহেব আমার সকল পড়ালেখা ও অভিজ্ঞতাকে ভ্রুক্ষেপ না করে এগুলোকে বাস্তবতার নিরীখে কাঁচা বলে উড়িয়ে দিলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই হোক বা না বুঝেই হোক।

তিনি আমাকে বললেন তুমি আমার ডাক্তারখানার এমপ্লয়ি হিসেবে কাজ শুরু কর। প্রথম দিন তিনি আমাকে তার ডাক্তারখানার গত পাঁচ-ছ বছরের যত কাগজপত্র আছে সেগুলো গোছানোর কাজ দিলেন। আমি প্রথমেই কতগুলো কাগজ দিলাম ট্র্যাশ করে। আমি অফিসরুমের জঞ্জাল দ্রুত সরানোর উদ্দেশ্যে যা যা ডাম্প করলাম তা আবার ট্র্যাশক্যান থেকে বের করতে হল। এভাবে কয়েকদিন ডাক্তার সাহেবের সাথে থেকে থেকে ডাক্তারিবিদ্যায়ও হাতেখড়ি নেয়া শেষ হল।

এরমাঝে বলে রাখি ন্যুইয়র্কে বাঙালিদের প্রায় আড়াইশ সংগঠন আছে। সবই সংগঠন; কিন্তু ব্যক্তিগত। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আবার ব্যক্তিগত হয় নাকি?
- হয়।
হয় বলেই এসব সংগঠনের হেডম্যানদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি, চুলোচুলি পর্যন্ত হয়।
ন্যুইয়র্কের বাঙলা সাংবাদিকতার মূল কাজ হল এই দুই শতাধিক সংগঠনের পাঁচ শতাধিক হেডম্যানদের প্রচারণা বা প্রপাগান্ডা কাভার করা। কোন কোন সংবাদকর্মীর ২০ থেকে ৫০ ডলার জনপ্রতি নিয়ে তাদের ছবিসম্বলিত গুণকীর্তন পত্রিকায় ছাপানোই হচ্ছে ন্যুইয়র্কে বাঙলা সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

আমি ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে কাজ করার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে প্রত্রিকা অফিসেও কাজ পাই। বিজ্ঞাপন চেয়ে ফোন করার কাজ। যদিও অপরিচিত লোকের টেলিফোন কল বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তেমন ফলপ্রসূ না, তথাপি এটা প্রাথমিক হোমওয়ার্ক হিসেবে গণ্য হতে পারে। মূলতঃ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আসে পত্রিকার গুণগত মান এবং প্রচারসংখ্যার উপর ভিত্তি করে। প্রচার সংখ্যার পরিসংখ্যানটা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রে কৈতববাদ বা ছলমাত্র।

একদিন একটা সংবাদ লেখার কাজ পেলাম। সংবাদটাই আমার মনিব ডাক্তার সাহেবের সাথে আমার সাংবাদিকতার কাজের ইতি টেনে দিল। ন্যুইয়র্কে নিজেকে অভিজ্ঞ সাংবাদিক বলে দাবি করা এক সাংবাদিক জুটেছে ডাক্তার সাহেবের সাথে। তিনি যতটা না সাংবাদিক তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত চর। অর্থাৎ পত্রিকার কর্মী হিসেবে তিনি যতটা না নিজের যোগ্যতা জাহির করতে চান, তারচেয়ে বেশি সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ডাক্তার সাহেবের কানে কানকথা টেন্ডার করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে তৎপর। ডাক্তার সাহেব কানকথা শোনেন কি না তা সবসময় বোঝার উপায় নেই। সম্প্রতি আমি যে সংবাদটা লিখলাম(যদিও সংবাদের পিছনে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ আছে), তা একজনের বিপক্ষে গেল। যার বিপক্ষে গেল তার নামে ন্যুইয়র্কের সবচেয়ে জাত সাংবাদিক বলে বড়াই করা সেই সহকর্মী একপর্যায়ে ডাক্তার সাহেবকেই ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলেন। কথাটার অবতারনা করলাম সাংবাদিকের চাকরি কতটা ভালনারেবল হলে একজন সাংবাদিককে ব্যক্তিগত চোগলখোরি বা চাটুকারিতায় লিপ্ত হতে হয় তা বোঝাতে। সাংবাদিকের বস পেশাদার সাংবাদিক হলে এতটা ভালনারেবল হত না একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা এখানে নতজানু। যে যাই বলুক, কোন না কোন সাংবাদিকের কঠোর পরিশ্রমে সংগ্রহ করা সংবাদগুলোকে কপি-পেস্ট করেই ন্যুইয়র্কের বাংলা সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠা ভরাট করা হচ্ছে। অতএব সাংবাদিকের প্রতি 'লুক ডাউন আপঅন' ভাবটা দেখানো এখানকার কোন পত্রিকা মালিকেরই উচিত না।

প্রবাসে নিজের কম্যুনিটিকে সেবা দিতে এতগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পরও কাগজগুলো হাতে নিলেই বোঝা যায় তাদের বৈশিষ্ট্যে সাংবাদিকতার মৌলিক চেতনা কতটা বিদ্যমান।