Wednesday, July 28, 2010

রাজনীতি করতে হলে 'রাজনৈতিক ভুলে'র জন্য ক্ষমা চাইতে বাধা কোথায়?

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে দু'হাজার সাত সালের এক-এগার থেকে শুরু করলে সুবিধা হয়। সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদকে নিয়ে প্রাক্তন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনীতিতে একধরনের চাপিয়ে দেয়া সংস্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বর্তমানে আবার পুরনো গণতান্ত্রিক ধারায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহন করে। সময়ের পরিবর্তনে অনেক জল গড়িয়েছে অনেক ধুলো জমেছে ইতিহাসের পটভূমিতে। সম্প্রতি বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাইফুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুসহ গত দশকে আমরা হারিয়েছি বড় অনেক রাজনীতিককে।

বর্তমান সরকারের সাথে জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে তার উৎপত্তি সুদূরে প্রোথিত হলেও প্রকট হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ থেকে। প্রথমে দুই প্রধান দলের দু'জন নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হয়। তারা দ্রব্যমূল্যের উধর্বগতি নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতির খোঁজখবর করতে করতে মিলিটারি অফিসাররা ভেতরে ভেতরে নিজেরা অনেক বড় বড় আর্থিক দুর্নীতি করেছেন বলে পরবর্তীকালে পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এতে আবারও প্রমান হল বাংলাদেশের ক্ষমতাধররা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে বেশ পাকা। তাছাড়া বিদ্যমান বিদগ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, যার সূত্র ধরেই রাজনীতিতে সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হস্তক্ষেপ হয়েছে। এ সময়টিতে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলায় কোন ত্রুটি নেই।
শেষপর্যন্ত আমরা একটি চলনসই ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার পেলেও বর্তমান সরকার গণতান্ত্রিক আচরণের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিতে কিছুটা ধাক্কা লেগেছিল । সে ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে যে পরিবর্তনটা আমাদের চোখে পড়েছে তাতে আমরা ভেবেছিলাম অচিরেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। দেশে এখন বাম দল বলে কোন রাজনৈতিক ধারা নেই যেহেতু জাঁদরেল বামরা নৌকা মার্কা নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ডানের কথা বললে বলা যায় তাদেরও অতীত বিতর্কে জড়িত থাকার কারণে দেশের সচেতন মহলে স্বীকৃতি নিয়ে টানাপোড়েন আছে।

জামায়াত ইসলামীর কথায় আসি। আসলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি যেতে চাই না। তার প্রথম কারণ ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে তা নিষিদ্ধ করা হয় নি। বিশেষ করে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতির মত প্রকাশের অধিকারের কারণে তা নিষিদ্ধ করা যায় না। দেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান নেতৃত্বের বিতর্কিত অবদানের জন্য- জামায়াতের ব্যাপারে দেশের সাধারণ জনগণের সন্দেহ রয়েছে। এটা স্বাভাবিক। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর এমনটাই মনোভাব।

বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালি-মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হিসেবে এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কেহই ইসলাম ধর্ম রক্ষার কথা কম বলে না। জামায়াতের সমস্যা হল তাদের গায়ে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারী তথা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের যে কালিমা লেগেছে তা থেকে তারা বের হয়ে আসেনি। পক্ষাবলম্বনটা নিরপরাধ ছিল না। যদি মনে করি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত অধ্যাপক গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদি, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারম্নজ্জামান ও কাদের মোল্লা প্রমুখ নেতারা বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষার রাজনীতি করছেন তাহলে ইসলাম ধর্মের প্রতি এবং জামায়াত ইসলামীর প্রতি তাদের দায়িত্ব অনেক। এমনকি মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্ম বা আদর্শ রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানি।

ইদানিং সমাজে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটে বিদেশী পত্রপত্রিকার আর্কাইভ থেকে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খবরাখবর পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেল মারফত আমরা দেখেছি জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সিদ্ধান্ত 'রাজনৈতিক ভুল' ছিল স্বীকার করে বক্তব্যও দিয়েছেন। কিন্তু তারা সে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা কখনও নিজেরাও বলেননি এবং সাংবাদিকরা ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ তুললে তারা কৌশলে সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে জামায়াত নেতাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে এমন প্রশ্নের উত্তরে নাকি তারা বলেছেন 'ক্ষমা চাইলে তাদের রাজনীতিক আদর্শ থেকে সরে যেতে হবে'। রিমান্ডের কথা পত্রিকায় কোন্ সূত্রে এসেছে বা তার সত্যতা সম্পর্কে না জেনেই বলা যায়- তারা যদি এমন কথা বলে থাকেন, তাহলে কিসের ভিত্তিতে ক্ষমা চাইলে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে যেতে হবে বলেছেন তা বোধগম্য নয়। কারণ ইসলামে ক্ষমা চাইতে বা ক্ষমা করতে কোন নিষেধ আছে বলে তো শুনিনি। আর তাদের রাজনীতির মূল আদর্শ তো ইসলাম। তাহলে ক্ষমা চাইলে আদর্শ বিচ্যুত হবে কি করে?

যা হোক প্রশ্ন যতই আসুক বা উত্তর যা-ই পাওয়া যাক জামায়াত ইসলামীর নেতারা তাদের কৃত 'ভুলে' জন্য ক্ষমা চাইতে এখনও প্রস্তুত নন বা এমন সিদ্ধান্তও নেননি এটাই বর্তমান অবস্থা।

জামায়াত ইসলামীর জুতোয় পা দিয়ে যদি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, এমন অনেকে আছেন জামায়াত করেন বা সমর্থন করেন বা ভোট দেন, কিন্তু তাদের একাত্তরের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। তাদের পক্ষ থেকে দেখলে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের আর দশটা রাজনৈতিক দলের মতই একটা রাজনৈতিক দল।

জামায়াত একটা রাজনৈতিক দল যেখানে ১৮ থেকে ৪০ বছরের যেসব কর্মী, সমর্থক ইত্যাদি আছেন তারাও ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যারা এ দলের পথিকৃত, চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বিরোধীতা করেছেন ও পাকিস্তানি আর্মির গণহত্যা, ধর্ষণসহ নানা দুষ্কর্মে সমর্থন ও প্রত্যক্ষ মদদ দেয়ার অভিযোগে দেশের রাজনীতিতে যাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তারাও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার রাজনীতি করছেন বলে তাদের মত। জামায়াতের রাজনীতিতে দায়টা তাহলে কোন অংশের বেশি? নেতৃস্থানীয়দের দায় বেশি এটা স্পষ্ট। নতুন প্রজন্ম আইডেন্টিটি সঙ্কটে ভোগে। তারা নিজেদের 'রাজাকার' পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। আবার পুরাতন, ঘুণেধরা প্রজন্ম তাদের বিতর্কিত আইডেন্টিটি রিপেয়ার করারও কোন চেষ্টা নেয়নি কখনও। গণতন্ত্রের অংশ হয়ে দেশের মূলধারায় নতুন প্রজন্মের জামাত-শিবিরের সদস্যরা হয়ত তাদের মেধা ও শক্তিকে দেশের জন্য কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু সমাজের সর্বসাধারণ্যে দলের বদনাম থাকার কারণে তাদের পক্ষে নিরাপত্তা বোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেউ কেউ হয়তো এখনো নিরবে পাকিস্তানের জন্য কাঁদেন। আবারও ইউনাইটেড পাকিস্তানের স্বপ্নও দেখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হল ইউনাইটেড পাকিস্তানের ধারণাটাই ছিল ভুল। কারণ পূর্ব ও পশ্চিমের মানুষের ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে কোন মিল নেই। চিন্তা-দর্শন বলুন, খাবার-খাদ্য বলুন, মেজাজ-মর্জি বলুন, ভাষা বলুন বা সংস্কৃতি বলুন। কোন কিছুতেই মিল নেই আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের। তাহলে ইউনাইটেড পাকিস্তানের ধারণা ভুল বলতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে এমন অনেককেই পাওয়া যাবে যারা সে স্বপ্ন ভুলতে পারেন না। এটা অন্যায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সেনাবাহিনী যে বর্বরতা দেখিয়েছে, তাতে তাদের যে হিংস্রতার পরিচয় পাওয়া গেছে, তারপরও কোন বাংলা মায়ের সন্তান পাকিস্তানের জন্য কাঁদতে পারে না।

বাঙালিরা খুবই ধার্মিক। তা সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান বা মুসলমান যেই হোক। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মতো দলের উপস্থিতি অবাস্তব নয়। অবাস্তব হল জামাত নেতাদের পাকিস্তানপ্রীতি।

এবার জামায়াত নেতাদের ইসলামপ্রীতির কথা বলি । তারা যদি ইসলামকে ভালবাসেন এ দাবি করেন তাহলে তারা নিজেদের 'ভুল' স্বীকার করে প্রকাশ্য জনসমক্ষে- তথা রেডিও-টিভি, পত্রপত্রিকা ও জনসভায় সাধারণ মানুষের কাছে সে 'ভুলে'র জন্য ক্ষমা চাইলেন না কেন? কেন তারা ক্ষমা চেয়ে পুনরায় ইসলামকে বাংলাদেশে রক্ষার জন্য রাজনীতি শুরু করলেন না? কেন তারা প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে সামরিকতন্ত্রের লেজ ধরে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে আসলেন। তাদের অন্তর যদি পরিস্কার হত তাহলে তারা এভাবে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে আসতেন না। অধ্যাপক গোলাম আজম স্বাধীনতার পরপরই দেশে এসে তার দলের লোকদের নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে রাজনীতি শুরু করতে পারতেন। তা থেকে বোঝা যায় তাদের অন্তরে কালি ছিল।

তদুপরি বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বাংলাদেশী প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষায় যোগ্য অনেক নবীন নেতা যখন জামায়াতকে পরিচালনা করার যোগ্যতা রাখেন তখনও নিজেদের কলঙ্ক নিয়ে তারা কেন শীর্ষ পদগুলো থেকে সরে যাচ্ছেন না? তাদের ভাষ্যমতে তারা তো নিজস্ব প্রাপ্তির জন্য রাজনীতি করেন না। তাহলে তারা কেন শীর্ষ পদের লোভ; নিয়ন্ত্রণের লোভ; পাওয়ার-প্র্যাকটিসের লোভ ছাড়তে পারছেন না। শীর্ষ জামাত নেতারা সবাই যদি তাদের নিজেদের অতীত কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হতেন, যদি তারা নিজেদের দাবী অনুযায়ী প্রকৃত মুসলমান হতেন তাহলে ক্ষমা চাইতেই বা ইতস্তত করবেন কেন? তাদের তো আরও আগেই উচিত ছিল বর্তমানে যে বিষয়টাকে তাদের 'রাজনৈতিক ভুল' বলে স্বীকার করছেন সে বিষয়টা নিষ্পত্তি করে ফেলা। এতদিন পরে এসে তারা বুঝলেন 'রাজনৈতিক ভুল', তাহলে ক্ষমা চাইতে কি আরও চলিস্নশ বছর অপেক্ষা করতে হবে?

দিনে দিনে অনেক জল গড়িয়ে, অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আজ অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একদিকে বর্তমান সরকারেরও বিরোধী দলকে কাবু করার স্বৈরাচারী মনোভাব আছে। অপরদিকে তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও যুদ্ধাপরাধের বিচার করার কথা বলেছে তারা। জামায়াতের যে অবস্থান তাতে তারা হয়ত অন্যকোন ইস্যুতে আন্দোলনে জনগণের সমর্থন পাবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জনগণের সমর্থন পাবে কি?

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আরও ছিল ঘরে ঘরে চাকুরির ব্যবস্থা করা, চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো। চাল-ডালের মূল্য কমানো তো দূরে থাক তারা এখন চালের মূল্য দ্বিগুণ করে ছেড়েছেন। আর চাকুরির কথা বললে- সরকারী দলের ক্যাডার বাহিনীকে নানাভাবে ওপেন কন্ট্রাক্টে সরকারী কাজ দেয়াসহ চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অন্যায় রোজগারের সুযোগ করে দেয়া ছাড়া ঘরে ঘরে চাকুরি দেয়ার কোন আলামতও মেলে না।

যাহোক, শেষ কথা হল জামায়াতের শীর্ষ নেতারা ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেই নতুন প্রজন্মের জামায়াত সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে, নচেৎ তাদের আলখাল্লার ভেতরে জমাট দেশের গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণে সমর্থন-সহযোগিতার অপরাধে অপরাধী অন্তর সচেতন মানুষকে কাছে টানতে পারবে না। শুধু তাই নয় যেসব মুক্তিযোদ্ধা অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরও বিচার হবে। অন্যায় সবসময়ই অন্যায়। সময়ের কাছে সকলেরই জবাবদিহিতা করতে হবে।

Thursday, July 15, 2010

পুরনো গাড়ি নিষিদ্ধ করার সরকারী ব্যবসা বন্ধ হোক

বাংলাদেশে যারা সরকারী ক্ষমতায় যায় বা যারা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে কর্মরত আমলা তারা জনগণের সেবায় খুব কমই মনোনিবেশ করেন। ক্ষমতাধরদের নিজেদের ব্যবসায়িক উন্নতিসাধনের পথে যদি জনগণের কোন উপকার সয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায় তাহলে তো খুবই ভাল কথা। এ ধরনের কাজে উভয়দিক থেকে ক্ষমতাধরদেরই লাভ। একদিকে জনগণ তাদের সেবা করা হয়েছে ভেবে সন্তুষ্ট থাকল। আবার ব্যবসা করে তাদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ ও হল।

প্রায় এক যুগ আগে দূষণের কথা বলে দুই স্ট্রোকের ইঞ্জিনবিশিষ্ট আমাদের অতি পরিচিত বেবি ট্যাক্সিগুলোকে যখন ঢাকা থেকে বিতাড়িত করা হল তখন আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি যে কিছু গাড়ি ব্যবসায়ীর রাতারাতি বিলিয়নপতি হয়ে যাওয়ার পথ খোলার জন্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব গাড়ি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তা যদি নাই হবে তাহলে ভারতীয় রুপি পঞ্চাশ হাজার দিয়ে যে সিএনজি বেবি ট্যাক্সি ভারতে বেচাকেনা হয়, তা বাঙলাদেশে পাঁচ থেকে সাত লক্ষ টাকা দাম হয় কীভাবে?

আমি যখন কথাটা জানলাম- একটা পুরনো সিএনজি বেবি ট্যাক্সি কিনতে এখন খরচ হয় পাঁচ লক্ষ টাকা আমি বিস্মিত হলাম। কারণ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি এত বেশি দাম হতে পারে এত হাল্কা এবং সস্তা ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটা গাড়ির। ফলত কী দাঁড়াল? ঢাকা শহরের প্রায় তিনকোটি সাধারণ মানুষ প্রতিদিন এর মাশুল গুণছেন। তিরিশ টাকা ভাড়ার পথ এখন একশ' টাকা দিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে।

একথা পরিষ্কার যে, বাঙলাদেশে যখনই কোন নতুন আইন বা নিয়ম চালু হয় তা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিছু লোককে সুবিধা দিতে; পাশাপাশি আপামর জনগণকে অসুবিধায় ফেলতে। আমি ছ'মাস আগে ঢাকায় যখন একটা সিএনজিতে উঠি তখন দেখলাম এর দু'দিকে লোহার গ্রিল দিয়ে দরজা বানিয়ে প্যাসেঞ্জারকে খাঁচার জন্তুর মত পরিবহন করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বেবি ট্যাক্সি অপারেটর আমাকে জানালেন এটা যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে বেবি ট্যাক্সিযোগে যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তা ঠেকানোর জন্য। কিন্তু মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে ঠিক কীভাবে ছিনতাইয়ের মত ঘটনার হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে এ নিয়ম করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য হয়নি। কারণ ড্রাইভার যদি দরজা তালা বন্ধ করে দেয় তাহলে যাত্রী ওখান থেকে বের হবার কোন উপায় নেই।

অতপর, ড্রাইভার সাহেব আমাকে জানালেন পুলিশ যদি রাস্তায় জিজ্ঞেস করে আমি মিটারের হিসেবে ভাড়া দেব নাকি ফিক্সড রেটে যাচ্ছি, তাহলে আমি যেন বলি মিটারে যাচ্ছি। যেহেতু সায়েদাবাদ থেকে একশ' আশি টাকার কমে আমি কাউকে শঙ্কর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে রাজি করাতে পারি নি। উপরন্তু আমার যাওয়া প্রয়োজন বাসট্যান্ড থেকে থেকে একটু ভিতরে জাফরাবাদ কিন্তু কেউ ভিতরে যেতেও রাজি হল না।

যাহোক আমার মূল কথা হল সরকার নিয়ম করেছিল মিটার ছাড়া ভাড়া আদায় করা যাবে না। কিন্তু রাস্তায় যখন একজন যাত্রী হাতে চার-পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে শিশু এবং মহিলাসহ যাতায়াত করেন তখন বেবি ট্যাক্সি বা ক্যাব অপারেটরদের কথা একপর্যায়ে মানতে তারা বাধ্য হন।

কিন্তু তার দু'সপ্তাহ পড়ে আমি যখন আবার সিএনজি বেবি ট্যাক্সিতে উঠলাম তখন আর ড্রাইভার আমাকে তেমন কোন অনুরোধ করলেন না। আমি জানতে চাইলে তিনি বললেন সে ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কারণ এখন বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে তারা পুলিশকে প্রতিদিনের মাশুল দিয়ে সে নিয়ম মানার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এখন কোন যাত্রী পুলিশকে যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও অভিযোগ করেন তাহলেও কোন কাজ হবে না।

নিয়ম কানুন, আইন-আদালত বাঙলাদেশে মানুষের উপকারের জন্যই আছে! তবে তাতে কোন ক্ষমতাবানের বিচার হয় না। সাধারণ জনগণ এই আইন-আদালত থেকে কোন উপকার পায় না। পাবে না। কথাটা প্রমাণিত হয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের একটি অংশকে বর্তমান সরকারের বাছবিচারহীনভাবে বিনাশর্তে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে।

প্রাচীন রোম ও গ্রিসে যে নগররাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল সেখানেই নাকি গণতন্ত্রের উৎপত্তি তা অনেকে জানেন। পাঠক এও জানেন তখনকার সচেতন নাগরিকদেরকে গণতান্ত্রিক উপায়েই দেশের বিচারকগণ মৃত্যুদণ্ডও দিতেন। এ ভাবেই মহামতি সক্রেটিসকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঙলাদেশেও প্রাচীন গ্রীসের সে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার আদলেই গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে।
শুরুতে যে কথা বলছিলাম ইতালিয়ান এঞ্জিন বিশিষ্ট প্রাচীন বেবি ট্যাক্সির বদলে সিএনজি বেবি ট্যাক্সির প্রচলন করে দেশের কিছু লোকের হাতে গরীর খেটে খাওয়া সিএনজি অপারেটরদের কষ্টার্জিত অর্থ তুলে দেওয়ার সিস্টেম চালু করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। যেখানে একজন ড্রাইভার হতে পারতেন সিএনজির মালিক সেখানে এখন ড্রাইভার পাঁচ-দশ বছর সিএনজি চালিয়েও মালিক হতে পারছেন না। কারণ তার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে সিএনজি বেবি ট্যাক্সির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফরিয়াদের পকেটে চলে যাচ্ছে শ্রমিক জনতার তথা মেহনতী মানুষের অর্থ।

ঘুষখোর প্রশাসন আর তাদের ক্লায়েন্টদের পকেটে চলে গেল সকল অর্থ। সাধারণ জনগণ হয়ে রইল খাঁচায় বদ্ধ চিড়িয়া।
এখন সরকারের কোন মন্ত্রীমিনিস্টার বা প্রশাসনের কোন ভারি মাথার লুলুপ দৃষ্টি পড়েছে একই রকম ব্যবসায়। আবার তারা বলছেন ঢাকায় বিশ বছরের পুরনো বাস, মিনিবাস চলতে দেয়া হবে না। এটা একটা চরম অন্যায্য যুক্তি। কারণ পৃথিবীর সকল দেশেই, সকল শহরেই পুরনো গাড়ি চলতে কোন বাধা নেই। যতক্ষণ এগুলো রাস্তায় চলার জন্য ফিট থাকবে ততক্ষণ এগুলো শহরের রাস্তায় চলতে পারে।

ঢাকার রাস্তাতো কোন এক্সপ্রেস হাইওয়ে না। যে এখানে দ্রুতগতির গাড়ি চালাতে হবে। ঢাকার রাস্তায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর কোন সুযোগ কোন অবস্থাতেই নেই। তারপরও এখানে নতুন নতুন যেসব গাড়ি নামানো হয়েছে সেগুলোর ইফিশিয়েন্সি অনেক কম। টাটা গাড়ি বা যত ভারতীয় গাড়ি আমি দেখেছি নতুন নতুন নামে নতুন সাজে তা শুধুমাত্র কিছু লোকের গাড়ির ব্যবসা বাড়ানোর জন্যই অতীতের সরকারগুলো এসব সুযোগ দিয়েছে। এসব গাড়ি গত ৮ থেকে ১০ বছর চলেই ইতিমধ্যে বেশ লক্করঝক্কর হয়ে গেছে।

অনুরূপ বর্তমান সরকার আসার পর এখন তাদের চেলা-চাটুকাররাও হয়তো বলছেন তাদের কিছু আয় রোজগার বাড়ানোর পথ বের করতে। তাই এখন আবার বর্তমান সরকার পুরনো অথচ ভালভাবে সচল বাস-মিনিবাসগুলোকে বের করে দিয়ে আগের মতই কিছু লোকের গাড়ি আমদানির ব্যবসা বাড়ানো এবং কিছু লোকের ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন উদ্ভট পরিবহন নাম দিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনিক গাড়িভাড়ার খরচ বাড়ানোর একটা ঘৃণিত পরিকল্পনা করেছে সরকারের উপদেষ্টা!রা।

বিদেশ থেকে আমরা যতই গাড়ি আমদানি করি এসবই আমাদের পরিবেশকে দূষণ করছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে নিঃশেষ করছে। আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়ার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। সরকার কেন এসব পরিকল্পনা করবে। একটা গণতান্ত্রিক সরকারের সকল এমপিরা বিত্তবাণ ক্ষমতাধর। তারা সাধারণ জনগণের সেবা কীভাবে করবেন!
তারা জানেন কীভাবে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া যায়। যারা রাজনৈতিক আন্দোলনে মারা পড়েন তারা বলতে পারবে না দেশের জন্য মরেছেন। বরং রাজনীতি ব্যবসায়ের উন্নতির জন্যই জীবন দেন তারা। প্রকৃত রাজনীতিক একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যারা প্রকৃতপক্ষেই জনগণের উপকারে কিছু করতে চান।

নষ্ট হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ গাড়িঘোড়া মেটালের জঞ্জাল বাড়াবে, পরিবেশ দূষণ করবে। পরিবেশবাদীরা রি-ইউজ এবং রি-সাইকেল করার উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের যে বিদ্যমান গাড়িঘোড়া আছে সেগুলোকেই আমাদের রি-ইউজ করা অতি জরুরী। মেটালের স্তুপ না বাড়িয়ে আমাদের উচিত কীভাবে দেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করা যায় সে চেষ্টা করা। আমাদের দেশে যত গাড়ি আছে সেগুলোকে রি-ইউজ করা দরকার। গাড়ি ব্যবসায়ীদের কিছুটা দমতে হবে এখন। বাড়তি গাড়ির জন্য ঢাকার রোড স্পেস বা রাস্তার ধারণক্ষমতা এবং পার্কিং এর জায়গা মোটেও নেই। আমরা যত বেশি গাড়ি দেশে আমদানি করব ততবেশি আমাদের যানজট, পরিবেশ দূষণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যতবেশি আমরা রি-ইউজ করতে থাকব ততবেশি আমরা দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনগণকে রক্ষা করতে পারব।

দেশের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর এ কথা বোধগম্য হওয়া দরকার।

Sunday, June 13, 2010

ন্যুইয়র্কের বাঙালি অভিবাসী সাংবাদিকতা

ন্যুইয়র্ক এসেছি চারমাস হল। দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর। এখানে বসে থাকার কোন ব্যবস্থা নাই। এসেই কী করব ভেবে পাইনা। এদিকে সপ্তাহ শেষে ঘরভাড়া দিতে হবে। মাসের শেষে টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল দিতে হবে। বিদ্যুত বিল, প্রতিদিন কম্যুটিং এর জন্য মেট্রো রেলে বা বাসে ভাড়ার পয়সা গুণতে হচ্ছে। কাজ খুঁজতে যাওয়া আসারও খরচও নেহাত কম না। তারপর দুপুরবেলা খিদে পেলে জাইরো, স্যান্ডউইচ, সিঙ্গারার খরচ আছে। দুই থেকে ছয় ডলার খরচ হয় লাঞ্চ করতে।

এখানে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে বলেছি কাজের সন্ধান দিতে। কাজ জুটেছে কনভেনিয়েন্ট স্টোরে। দোকানদারি। ভাল কাজ। কিন্তু বেতন কম। ঘণ্টা হিসেবে পয়সা দেয় সবাই। কাজের মনিব যদি মনে করে কামাই কম হচ্ছে তখন নিজের রোজগারে যাতে প্রভাব না পড়ে সে জন্য অগ্রিম সতর্কতা হিসেবে আওয়ার কমিয়ে দেয় কর্মচারীর। স্বল্পপুঁজির দোকানপাটের কথা বাদ দিলেও মাঝারি, বড় এমনকি কর্পোরেশনগুলোতেও ২০০৭ সালের আমেরিকার অর্থনৈতিক ধ্বসের ফলস্বরূপ গত তিনবছর এখানে লক্ষ লক্ষ লোকের চাকুরিচ্যুতি থেকে শুরু করে নানা ধরনের দুঃসংবাদ লেগেই আছে। কয়েকদিন আগেও আমার বন্ধু দ্বিতীয় যে কাজটি করত রেস্তোরাঁয় সে কাজ চলে গেল। তারা আর পার্ট টাইমার রাখবে না। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের খরচ বাঁচানো দরকার।

৭০ হাজার কোটি ডলারের উদ্ধার প্রস্তাব পাশ করেও আমেরিকার সরকার সাধারণ নাগরিকদের কোন স্বস্তি দিতে পারেনি এখনও।
মানুষ চাকুরি হারানো থেকে শুরু করে আয়রোজগারে অধগতি উপরন্তু দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, যাতায়াত ভাড়া, ঘরভাড়া ইত্যাদি বৃদ্ধিসহ চারদিকের চাপে মানুষ ন্যুব্জ। ফলে রেস্টুরেন্ট, গ্যাস স্টেশন, গ্রসারি, কনভেনিয়েন্ট স্টোরের ব্যবসাগুলোতে খরিদ্দারদের ভীড় আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। সকলের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে যা তামাম যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

এমন এক সময়ে আমি এসেছি ন্যুইয়র্ক শহরে। ভেবেছিলাম বড় শহরের অনেক সুযোগের ভিড়ে আমি নিজের জায়গা করে নিতে পারব। কিন্তু তার কোন আলামত পেলাম না প্রথম একমাস।

একমাস পরে শুরু করলাম টিউশানি। ন্যুইয়র্ক শহরে ঢাকা শহরের মতই মসজিদ, ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসা তথা ইসলামিক স্কুল আর কোচিং সেন্টারে ভর্তি। মন্দির, গির্জা, পেগোডারও অভাব নেই এখানে। অমুক ক্যাথলিক চার্চ, অমুক ব্যাপ্টিস্ট চার্চ গলিতে গলিতে; কেউ শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত তো কেউ রামের, কোন কিছুরই অভাব নেই। পাশাপাশি ডেভিল আর সেইন্টের দেখা মিলবে এই ন্যুইয়র্ক শহরেই। মসজিদের ধারেকাছেই হয়ত মিলবে নগ্ন নৃত্যের ক্লাব। মোটকথা সবধরনের সুযোগই আছে এখানে। তাই এখানে আসল সাধু আর আসল চোরের দেখা মেলে। কারো সুযোগের অভাবে সাধু সাজার দরকার পড়ে না এখানে। তাই মানুষের আসল চেহার বেরিয়ে পড়ে এই ন্যুইয়র্ক শহরে।

যে কথা বলছিলাম, টিউশানি করে এখানে লক্ষ লক্ষ ডলারের কোচিং সেন্টারের মালিক হয়েছেন কেউ কেউ। আমি নতুন এসে কি জায়গা পাই এখানে? তবুও একটা সেভেনের বাচ্চাকে অঙ্ক করানোর কাজ পেলাম; তবে রোজগার তেমন কিছু না। নতুন মাস্টারকে চলতি রেট দিবে কেন? আমার নামডাক হলে আমাকে প্রয়োজনে দিগুণ দিতেও গায়ে লাগবে না।

একসময় ভাবলাম আচ্ছা এবার দেখি নিজের পেশা সাংবাদিকতায় কী করতে পারি। ন্যুইয়র্কে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় পনের ষোলটা সাপ্তাহিক বাঙলা পত্রিকা বেরয়। তারা শুধু বিজ্ঞাপনের পয়সা রোজগারের জন্যই পত্রিকা ছাপায় এমন না, কেউ কেউ সমাজে অর্থের পাশাপাশি নামডাকের জন্যও পত্রিকা প্রকাশ করেন। টিপিক্যাল। পেশাদারিত্ব নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কতটুকু সে প্রশ্নে আসছি পরে।

বেশিরভাগ পত্রিকা মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গেলে বা চাল-ডাল কিনতে গেলে বিনামূল্যে মেলে। তারই একটা নিয়ে আমার ন্যুইয়র্কের সাংবাদিকতার সূচনা করব বলে ফোন তুললাম। নিজের কথা বললাম। অপর প্রান্ত থেকে জানাল আমাদের বসকে ফোন দিন তিনি বলতে পারবেন কাজ আছে কি না। দিলাম বসকে ফোন। বলালাম সাংবাদিকতায় পড়াশুনার পাশাপাশি পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বললেন অমুকদিন আসুন। রেজুমে নিয়ে গেলাম তার কাছে। তিনি পেশায় ডাক্তার।

জানালেন তার পত্রিকার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার কথা। পত্রিকার পেজমেকাপ হয় বাংলাদেশে। অর্থাৎ পেজমেকাপ রিমোটলি কন্ট্রোলড্। তিনি আমার ডিগ্রি বা পেশাদারিত্বের দিকে কর্ণপাতও করলেন না। বরং তার নিজস্ব সিস্টেমে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানালেন। তার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিদের অসততার কথা বললেন। আমি নিজের ব্যাপারে কিছু বলে নিজের যোগ্যতা যতবারই জাহির করতে গেলাম ততবারই তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকা প্রকাশ করছেন অতএব তিনি ন্যুইয়র্কে পত্রিকা পরিচালনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বোঝেন। যাই হোক আমাকে কাজ দেবার কোন পরিস্কার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে একসপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে বললেন।

আমি যতবারই তার সাথে কথা বললাম ততবারই বোঝাতে চেয়েছি সাংবাদিকতার ধরন পরিবর্তনের কথা কিন্তু তিনি এসব নিয়ে নতুন করে কোন এক্সপেরিমেন্ট করতে নারাজ।

ন্যুইয়র্কের বাংলাদেশি কম্যুনিটির দিকে তাকালে বোঝা যায় আসলে সাংবাদিকতার মৌলিক চর্চা ঠিক রাখতে গেলেও যে ধরনের enterprise দরকার তা এখানে অনুপস্থিত। যদি সে ধরনের কোন informed উদ্যোক্তা থাকেন তাহলে এখানে বাঙলা সাংবাদিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে হয়েছে আমার। যাই হোক উল্লেখিত ডাক্তার সাহেব আমার সকল পড়ালেখা ও অভিজ্ঞতাকে ভ্রুক্ষেপ না করে এগুলোকে বাস্তবতার নিরীখে কাঁচা বলে উড়িয়ে দিলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই হোক বা না বুঝেই হোক।

তিনি আমাকে বললেন তুমি আমার ডাক্তারখানার এমপ্লয়ি হিসেবে কাজ শুরু কর। প্রথম দিন তিনি আমাকে তার ডাক্তারখানার গত পাঁচ-ছ বছরের যত কাগজপত্র আছে সেগুলো গোছানোর কাজ দিলেন। আমি প্রথমেই কতগুলো কাগজ দিলাম ট্র্যাশ করে। আমি অফিসরুমের জঞ্জাল দ্রুত সরানোর উদ্দেশ্যে যা যা ডাম্প করলাম তা আবার ট্র্যাশক্যান থেকে বের করতে হল। এভাবে কয়েকদিন ডাক্তার সাহেবের সাথে থেকে থেকে ডাক্তারিবিদ্যায়ও হাতেখড়ি নেয়া শেষ হল।

এরমাঝে বলে রাখি ন্যুইয়র্কে বাঙালিদের প্রায় আড়াইশ সংগঠন আছে। সবই সংগঠন; কিন্তু ব্যক্তিগত। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আবার ব্যক্তিগত হয় নাকি?
- হয়।
হয় বলেই এসব সংগঠনের হেডম্যানদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি, চুলোচুলি পর্যন্ত হয়।
ন্যুইয়র্কের বাঙলা সাংবাদিকতার মূল কাজ হল এই দুই শতাধিক সংগঠনের পাঁচ শতাধিক হেডম্যানদের প্রচারণা বা প্রপাগান্ডা কাভার করা। কোন কোন সংবাদকর্মীর ২০ থেকে ৫০ ডলার জনপ্রতি নিয়ে তাদের ছবিসম্বলিত গুণকীর্তন পত্রিকায় ছাপানোই হচ্ছে ন্যুইয়র্কে বাঙলা সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

আমি ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে কাজ করার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে প্রত্রিকা অফিসেও কাজ পাই। বিজ্ঞাপন চেয়ে ফোন করার কাজ। যদিও অপরিচিত লোকের টেলিফোন কল বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তেমন ফলপ্রসূ না, তথাপি এটা প্রাথমিক হোমওয়ার্ক হিসেবে গণ্য হতে পারে। মূলতঃ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আসে পত্রিকার গুণগত মান এবং প্রচারসংখ্যার উপর ভিত্তি করে। প্রচার সংখ্যার পরিসংখ্যানটা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রে কৈতববাদ বা ছলমাত্র।

একদিন একটা সংবাদ লেখার কাজ পেলাম। সংবাদটাই আমার মনিব ডাক্তার সাহেবের সাথে আমার সাংবাদিকতার কাজের ইতি টেনে দিল। ন্যুইয়র্কে নিজেকে অভিজ্ঞ সাংবাদিক বলে দাবি করা এক সাংবাদিক জুটেছে ডাক্তার সাহেবের সাথে। তিনি যতটা না সাংবাদিক তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত চর। অর্থাৎ পত্রিকার কর্মী হিসেবে তিনি যতটা না নিজের যোগ্যতা জাহির করতে চান, তারচেয়ে বেশি সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ডাক্তার সাহেবের কানে কানকথা টেন্ডার করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে তৎপর। ডাক্তার সাহেব কানকথা শোনেন কি না তা সবসময় বোঝার উপায় নেই। সম্প্রতি আমি যে সংবাদটা লিখলাম(যদিও সংবাদের পিছনে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ আছে), তা একজনের বিপক্ষে গেল। যার বিপক্ষে গেল তার নামে ন্যুইয়র্কের সবচেয়ে জাত সাংবাদিক বলে বড়াই করা সেই সহকর্মী একপর্যায়ে ডাক্তার সাহেবকেই ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলেন। কথাটার অবতারনা করলাম সাংবাদিকের চাকরি কতটা ভালনারেবল হলে একজন সাংবাদিককে ব্যক্তিগত চোগলখোরি বা চাটুকারিতায় লিপ্ত হতে হয় তা বোঝাতে। সাংবাদিকের বস পেশাদার সাংবাদিক হলে এতটা ভালনারেবল হত না একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা এখানে নতজানু। যে যাই বলুক, কোন না কোন সাংবাদিকের কঠোর পরিশ্রমে সংগ্রহ করা সংবাদগুলোকে কপি-পেস্ট করেই ন্যুইয়র্কের বাংলা সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠা ভরাট করা হচ্ছে। অতএব সাংবাদিকের প্রতি 'লুক ডাউন আপঅন' ভাবটা দেখানো এখানকার কোন পত্রিকা মালিকেরই উচিত না।

প্রবাসে নিজের কম্যুনিটিকে সেবা দিতে এতগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পরও কাগজগুলো হাতে নিলেই বোঝা যায় তাদের বৈশিষ্ট্যে সাংবাদিকতার মৌলিক চেতনা কতটা বিদ্যমান।

Wednesday, March 31, 2010

কবিতা

অপূর্ব প্রতিশোধ
লিখেছেন কালিদাস রায়

"পুত্র, তোমার হত্যাকারীরে পাইনিক আজো ঢুঁড়ে -
আফসোস্ তাই জ্বলিছে সদাই তামাম কলিজা জুড়ে।
তার তাজা খুনে ওজু করে আজো নামাজ পড়িনি তাই
আত্মা তোমার ঘুরিছে ধরায়, স্বর্গে পায়নি ঠাঁই।
বাঁচিয়া থাকার কথা নয় আর তোমারে হারায়ে, বাপ,
কেবল তোমার মুক্তির লাগি সই দুনিয়ার তাপ।"

বলিতে বলিতে রুমালে অশ্রু মুছিলেন ইউসুফ,
হেনকালে এক ঘটনা ঘটিল অদ্ভুত, অপরূপ।

শশকের মত ত্রস্ত-ব্যস্ত পলাতক এক ছুটে
থরথর ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে চরণে পড়িল লুটে,
কহিল, - "জনাব রক্ষা করুন দুশমন পিছে ধায়।
দিন দয়া ক'রে আপনার ঘরে আশ্রয় অভাগায়।"
ইউসুফ ক'ন - "আল্লাহর ঘর মোর ঘর কেন কহ?
অজানা অতিথি, নির্ভয়ে তুমি তাঁর ঈদগাতে রহ।"

বহুদিন পরে ঘুমাল অতিথি মখমলী বিছিানায়,
হেন দামী খানা বহুকাল তার জুটেনিক রসনায়।

সুখ সুপ্তরে জাগাইয়া ক'ন শেষরাতে ইউসুফ -
"অজানা অতিথি, পালাও এবার দুনিয়া এখনো চুপ।
লও টাকাকড়ি, দুদিনের খানা আর লও তরবারি,
আশখানা হ'তে ঘোড়া বেছে নিয়ে চলে যাও তাড়াতাড়ি।

নড়িতে চাহে না মুসাফির বলে, - "বাঁচিতে চাই না আর
জীবন আমার সঁপিলাম, পীর, পুত পদে আপনার।
ইব্রাহিমের গুপ্তঘাতক আমি ছাড়া কেউ নয়,
ঐ অসিখানা এ বুকে হানুন সত্যের হোক জয়।"

বৃদ্ধের আঁখি বজ্রের মত সহসা উঠিল জ্বলি'
বজ্রদীর্ণ মেঘের মতনই অশ্রুতে গেল গলি।

কহিল বৃদ্ধ - "এতদিনে এলি, এতকাল খুঁজিলাম,
নিজে এসে হাতে ধরা দিলি আজ! ঘাতক, কি তোর নাম?
থাক- নামে আর কি কাজ আমার- মাফ করিলাম, তোরে,
সব-সেরা ঘোড়া দিলাম, এখনি পালা তার পিঠে চ'ড়ে।
পাঁচগুণ টাকা নিয়ে যা সঙ্গে চ'লে যা সুদূর দেশে,
মানুষের মন বড় দুর্বল, কাজ কি এদিকে এসে।"

তারপর চেয়ে আসমান পানে বৃদ্ধ কহিল - "বাপ
শত্রুরে তোর তলোয়ার তলে পেয়েও করিনু মাফ।
এতদিন পরে তোর হত্যার লইলাম প্রতিশোধ,
খুনের নেশায় আর করিব না আখেরের পথরোধ।"

Saturday, February 20, 2010

পুরনো কবিতা

এক গঞ্জের গল্প
লিখেছেন - হুমায়ুন কবির


আমাদের গঞ্জের ছিদাম পাইকের কথা বলি
তাসের আড্ডা, সস্তা চা খানা, তামাকের
কালচে-নীল ধোঁয়ার মাঝে পরাণ কামারের
আটচালায় নানা স্মৃতি নিয়ে সে
ব্যস্ত থাকে সর্বদাই।

- ওহে জগবন্ধু, কত দিয়ে কিনলে ইলিশ?
ধান কী দর, কালু, ছেলেটাকে পড়িও ব্যাপারী
আমরা জোয়ান কালে, হুঁ হুঁ বাবা -
এই সব বলতে ছিদাম শিবনেত্র হয়ে যেত,
সেই কাল সামনে এসে হাত-পা নাচাত প্রত্যহ।
সেবার কী যেন হোল ঢাকায় সদরেও
পুলিশ কী নিয়ে যেন গুলি ও লাঠিতে
বহু ছেলে মেরে ফেলে। গঞ্জেও
এসেছে হরতাল, নিতাই, গফুর, সাধু,
জলিল, পঞ্চা বসে ছক কাটে কী কী
করা যাবে। বৃদ্ধ কেউ পাশে
বলে - বাবা সব, ঝাণ্ডায় মোদের কথা
লিখে দিও, অজন্মার খাজনা মকুব চাই
ওসির জুলুম বড়, চৌকিদারি ট্যাকসোও দেব না।
ছিদাম জাবর কাটে কি আর মিছিল হবে
হুঁ হুঁ বাবা গান্ধী মহারাজ মিস্টার জিন্নাহর কালে
হইছে মিছিল আর তোরা হুঁ হুঁ ... বাবা।

গঞ্জেও চলেছে গুলি, দু'জন মরেছে
জখম অনেক জন। আশপাশ গাঁয়ের কিষাণ
স্কুলের সকল ছেলে সাঁকো ভেঙ্গে পুলিশের দঙ্গল
কাসুন্দ্যার চরে ধরে চারিদিক থেকে
ন্যাজা ও বাঁশের লাঠি, বল্লম, গুলতি
দশ হাজার লোক হবে ঘিরে আসে খাকীর দঙ্গল
আবার চলল গুলি, কতজন মরছে কে জানে।
কিষাণেরা ঘিরে ধরে অবশেষে মারছে পুলিশ
বারান্দাঅলা টুপি পরা অফিসার হাত জোর করে
মাফ চায়।

এদিকে ছিদাম পাইক গান্ধী-জিন্নাহর কাল ভুলে
পিট পিট করে চায় আরে এ ত জব্বর লড়াই
হুঁ হুঁ বাবা কিষাণের ব্যাটা তেজালো হাতে
হাতিয়ার দিয়ে জঙ্গ করে। হুঁ হুঁ বাবা দেখালি লড়াই...।

পুরনো ছড়া

সবার আমি ছাত্র
লিখেছেন - সুনির্মল বসু

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে ।

পাহাড় শিখায় তাহার সমান -
হই যেন ভাই মৌণ-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে -
দিল খোলা হই তাইরে ।

সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে ।

ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর -
অন্তর হোক রত্ন আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে ।

মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষাণ দিল দীক্ষা ।

ঝরণা তাহার সহজ গানে,
গান জাগালো আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা ।

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র ।

এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যে সব পতায় পাতায়
শিখছি সেসব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র ।