আমাদের সকলের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। সকলের প্রিয় শিক্ষক এজন্য যে যারা তাঁর ছাত্র ছিলেন তারা প্রায় সবাই তাঁকে ভালবাসতেন। তাঁর কথাবার্তা, আচরণ সবই ছিল সুন্দর, মধুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। অসময়ে প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯৮ সালে। তিনি অনেক অধ্যয়ন করতেন। বাঙলা ভাষার প্রতি তিনি গভীর প্রেম অনুভব করতেন বলেই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে রাতদিন বাঙলা সাহিত্যে ডুবে থাকতেন। বাঙলা বিভাগের ছাত্ররা ব্যতিত যারা বাকশিল্পের সাথে জড়িত তাদেরও অনেকের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বাঙলা উচ্চারণের সূত্র পড়াতেন। এমন শুষ্ক, নিরস বিষয়কে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতেন যে সবাই পিনপতন নিরবতায় শোনত।
তাঁর সাথে আমাদের যোগ ছিল আবৃত্তির ক্লাসের মাধ্যমে। তাই তাকে বেশি জানার সুযোগ হয়নি বলে বেশি কিছু বলার দৃষ্টতা দেখাব না। শব্দরূপ এর প্রযোজনায় নরেন স্যারের বাঙলা উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতাগুলো অডিও টেপে ধারণ করা হয়। আমার সংগ্রহে ছিল সবগুলো বক্তৃতা। স্যারের দুই কন্যা মনীষা বিশ্বাস ও নন্দিনী বিশ্বাসের নাম ছিল প্রযোজনায়।
তারপর স্যার চলে যান। রেখে গেছেন আমাদের প্রিয় নরেন বিশ্বাসের স্নেহ, মমতায় ভরা বাঙলা উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতামালা।
দেখতে দেখতে দিন বদলে গেল। অডিও টেপ এখন আর কেউ বাজায় না। সবার ঘরে অডিও টেপ এর ক্যাসেট প্লেয়ারের পরিবর্তে শোভা পেতে লাগল সিডি প্লেয়ার অতপর ডিভিডি ও মাল্টিমিডিয়া প্লেয়ার। সবই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। পুরনো প্রযুক্তির ভিসিপি বা ক্যাসেট প্লেয়ার অনেক ঘর থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিতে শুরু করল।
বাজানোর যন্ত্রের অভাবে প্রায় সবারই অডিও টেপগুলো হয়তো আর বাজানো হয় না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে বলল অডিও টেপগুলো সিডিতে ধারন করতে। আমার কাছে তেমন কোন যন্ত্রপাতি ছিল না। আমি স্যারের বক্তৃতাগুলো হারিয়ে যাবার ভয়ে একসময় আনাড়ি একটা প্রকল্প নিলাম। একটা অডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে টেপগুলো বাজিয়ে কম্পিউটারের হেডফোনের মাইক দিয়ে উনন্ডোজ্ সাউন্ড রেকর্ডারে রেকর্ড করলাম wave ফাইল হিসেবে। অডিও টেপের প্রতিটি ফাইল বিশাল আকারের হল। প্রতিটি ত্রিশ মিনিটের ফাইল হল ৭২ মেগাবাইট। তারপর অডিও সিডি আকারে রেকর্ড করার ঝামেলা পোহাতে পারি নি। দুএকটা ফাইল রেকর্ড করেছিলাম। প্রথম প্রথম বাজলেও পরে বাজেনি ভালভাবে। হয়ত সিডিগুলো ভালমানের ছিল না বলে।
প্রযুক্তি আরও এগিয়ে গিয়ে এখন ইন্টারনেটের যুগ। অনেকেই রাতদিন এই তথ্যের অন্তর্জালে ডুবে থাকেন। তথ্যের খোঁজে। কেউ ব্লগিং করেন। বিভিন্ন ওয়েবসাইট বিনামূল্যে তথ্য সংরক্ষণের সুযোগ দেয়। এমনই একটি সাইটে আমি নরেন স্যারের বক্তৃতাগুলো mp3 ফাইল আকারে রেখে দিলাম।
আবারও একবন্ধু বললেন এগুলোর অডিও সিডির কথা। সময় ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রের অভাবে আমি ভাবলাম সবাই যাতে শেয়ার করতে পারে এমন একটা ব্যবস্থা করে দিলে অত্যাধুনিক যুগের এসব ব্যবহারকারীরা তাদের প্রয়োজন মত শুনতে পারবেন প্রিয় শিক্ষকের বক্তৃতাগুলো। সকলের জন্য আমি আমার সাধ্যমত সহজে শোনার উপায় করে দিয়েছি এই ব্লগে। কোন ঝামেলা ছাড়া প্লে আইকনে ক্লিক করলেই বাজতে শুরু করবে প্রাণবন্ত এই বক্তৃতাগুলো।
সবচেয়ে বড় কথা আমাদের মাতৃভাষা বাঙলার উপর করা এ বক্তৃতাগুলো এক একটা রত্ন। আমরা বাঙালি। বাঙালি বীরেরা জীবন দিয়েছেন মাতৃভাষার জন্য। এজন্য আমরা পৃথিবীতে এক গর্বিত জাতি। ২১ শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়েছে। ১৯৯৯ সালের নবেম্বর মাসে ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। ২০০০ সাল থেকে এখন এই দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাঙলা ভাষাভাষিরা নিজের ভাষাকে বলায় এবং লেখায় কতটা অবহেলা করি!
স্যারের কথামত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি ভাষার উচ্চারণ বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া যেত তাহলে অনায়াসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথ্য বাঙলায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসত। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ কথাবার্তায় প্রমিত উচ্চারণের ধার ধারে না। যা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।
যা হোক আমি আমার ব্লগে যে এই বক্তৃতাগুলো তুলে দিলাম এর পাবলিক প্রকাশের কপিরাইট (সত্ত্বাধিকার) আমার নেই। এই লেখার মাধ্যমে মনীষা বিশ্বাস ও নন্দিনী বিশ্বাসের কাছে আমি অনুরোধ জানাব তারা যেন আমাকে সেই প্রকাশ পরবর্তী অনুমতি দিয়ে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য আবহে বাঙলা উচ্চারণের পাঠ শোনার পথ করে দেন।
Thursday, November 27, 2008
Tuesday, November 25, 2008
Subscribe to:
Posts (Atom)